গোপনীয়তার প্রাচীর ভাঙার দায়ে গুগল ও শেইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জরিমানা, ফ্রান্সের কড়া বার্তা
Bug Mohol Cyber Desk | তারিখ: ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডিজিটাল যুগে ব্যবহারকারীর তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষত, যখন বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি সংস্থাগুলো তাদের ব্যবসার স্বার্থে ব্যবহারকারীর ডেটা সংগ্রহে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। এই পরিস্থিতিতে, ফ্রান্সের ডেটা সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ, ন্যাশনাল কমিশন অন ইনফরমেটিকস অ্যান্ড লিবার্টি (CNIL), এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা টেক জায়ান্ট গুগল এবং চীনের ই-কমার্স behemoth শেইনকে বিপুল অঙ্কের জরিমানা করেছে। এই ঘটনাটি শুধু ফ্রান্স নয়, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি শিল্পের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে। সিএনআইএল-এর এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে, ব্যবহারকারীর সম্মতি ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করা আর কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
কুকি সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা
সিএনআইএল-এর মূল অভিযোগ ছিল গুগল এবং শেইন উভয়ই ব্যবহারকারীর সুস্পষ্ট সম্মতি ছাড়াই তাদের ব্রাউজারে বিজ্ঞাপন কুকি স্থাপন করছিল। এই কুকিগুলো ব্যবহারকারীর অনলাইন কার্যকলাপ ট্র্যাক করে এবং তাদের পছন্দ ও আগ্রহ অনুযায়ী ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে। ফ্রান্সের ডেটা সুরক্ষা আইন (Article 82) অনুসারে, এই ধরনের কুকি স্থাপনের জন্য ব্যবহারকারীর থেকে একটি "অবহিত ও সুস্পষ্ট" সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।
গুগলের ক্ষেত্রে, সিএনআইএল জানায়, যখন ব্যবহারকারীরা একটি নতুন গুগল অ্যাকাউন্ট তৈরি করতেন, তখন তাদের ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের জন্য কুকি বেছে নিতে উৎসাহিত করা হতো। এর ফলে ব্যবহারকারীরা সঠিকভাবে বুঝতে পারতেন না যে বিজ্ঞাপন কুকি ব্যবহার করা তাদের গুগল পরিষেবা ব্যবহারের একটি অলিখিত শর্ত। সিএনআইএল স্পষ্ট করে বলেছে যে এই ধরনের "অবহিত সম্মতিহীন" কার্যক্রম ফরাসি আইন লঙ্ঘন করে। যদিও গুগল পরবর্তীতে তাদের সিস্টেমে পরিবর্তন এনেছে এবং ব্যবহারকারীদের কুকি প্রত্যাখ্যান করার বিকল্প দিয়েছে, সিএনআইএল-এর মতে, এই সমস্যাটি সম্পূর্ণরূপে সমাধান হয়নি।
অপরদিকে, চীনা ই-কমার্স জায়ান্ট শেইনও একই ধরনের ভুল করেছে এবং তাদের সিস্টেমে এই ত্রুটি থাকার কারণে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়েছে। রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেইন তাদের সিস্টেমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনেছে এবং এখন তারা নিয়ম মেনে চলছে, তবে তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানিয়েছে।
Gmail এবং অন্যান্য গোপনীয়তা লঙ্ঘন
কুকি লঙ্ঘনের পাশাপাশি, গুগলকে আরও কিছু গুরুতর গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো Gmail-এর 'Promotions' এবং 'Social' ট্যাবে বিজ্ঞাপনের ইমেল প্রদর্শন। সিএনআইএল-এর মতে, এই বিজ্ঞাপনগুলো প্রদর্শনের জন্য গুগল ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট সম্মতি নেয়নি, যা ফ্রান্সের পোস্টাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশনস কোড (CPCE)-এর লঙ্ঘন। সিএনআইএল এই ধরনের পদক্ষেপের জন্য ফরাসি টেলিকমিউনিকেশন অপারেটর Orange-কেও $৫০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করেছিল। গুগলকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাদের সিস্টেমে এই ত্রুটি সংশোধন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্যথায় প্রতিদিন €১০০,০০০ জরিমানা দিতে হবে।
ফ্রান্সের এই পদক্ষেপের ঠিক পরপরই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও গুগলকে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য বড় ধাক্কা খেতে হয়েছে। একটি মার্কিন জুরি রায় দিয়েছে যে, গুগল ব্যবহারকারীর 'Web & App Activity tracking' বন্ধ করার পরেও তাদের ডেটা সংগ্রহ করে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছে। এই মামলার ফলে $425 মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে গুগল। গুগল অবশ্য এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পরিকল্পনা করছে।
শিশুদের ডেটা সুরক্ষায় কঠোরতা
ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি, শিশুদের অনলাইন গোপনীয়তা রক্ষা করা এখন বিশ্বব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন (FTC) এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি, ডিজনিকে $১০ মিলিয়ন জরিমানা দিতে হয়েছে। অভিযোগ ছিল, ইউটিউবে 'Made for Kids' হিসেবে সঠিকভাবে চিহ্নিত না করা ভিডিওগুলোর মাধ্যমে তারা ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করছিল। এই ডেটা ব্যবহার করে শিশুদের জন্য ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন তৈরি করা হতো, যা ইউএস চিলড্রেনস অনলাইন প্রাইভেসি প্রোটেকশন রুল (COPPA)-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এই ঘটনার পর, ডিজনিকে এখন থেকে শিশুদের কাছ থেকে ডেটা সংগ্রহ করার আগে তাদের অভিভাবকদের অবহিত করতে এবং সম্মতি নিতে হবে। এছাড়াও, তাদের ইউটিউব ভিডিওগুলো সঠিকভাবে 'Made for Kids' হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য একটি প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে।
একইভাবে, এফটিসি একটি চীন-ভিত্তিক রোবট খেলনা প্রস্তুতকারক Apitor Technology-এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। অভিযোগ অনুযায়ী, Apitor তাদের অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে একটি থার্ড-পার্টি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কিট (SDK) ব্যবহার করছিল, যা শিশুদের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই তাদের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কিত ডেটা সংগ্রহ করে JPush নামের একটি সংস্থার সার্ভারে পাঠাতো। এফটিসি স্পষ্ট করে বলেছে, এই ডেটা অনৈতিকভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে।
উপসংহার
গুগল, শেইন, ডিজনি এবং Apitor-এর বিরুদ্ধে এই কঠোর পদক্ষেপগুলি প্রমাণ করে যে, ডেটা সুরক্ষা এখন আর কেবল একটি আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক এবং বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতা। বিশ্বজুড়ে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীদের, বিশেষ করে শিশুদের ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষায় আরও কঠোর হচ্ছে। প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা যে, তাদের অবশ্যই ডেটা সুরক্ষা আইন মেনে চলতে হবে এবং ব্যবহারকারীর গোপনীয়তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভবিষ্যতে, যে সমস্ত কোম্পানি এই নিয়মগুলো মেনে চলতে ব্যর্থ হবে, তাদের জন্য আরও বড় অঙ্কের জরিমানা এবং আইনি ঝামেলা অপেক্ষা করছে। এই ধরনের কড়া পদক্ষেপগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করতে সাহায্য করবে এবং ব্যবহারকারীদের ডেটা সুরক্ষায় একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করবে।
🔔 আমাদের সাথে থাকুন — Bug Mohol এ বাংলায় সাইবার দুনিয়ার গভীরতম বিশ্লেষণ পাবেন।