দৃষ্টিশক্তি ফেরাবে নিউরালিংকের নতুন ব্রেন চিপ: অন্ধত্বের অবসান? | Bug Mohol

ইলন মাস্কের নিউরালিংক ব্রেন চিপ কি অন্ধত্ব দূর করবে? জানুন যুগান্তকারী 'ব্লাইন্ডসাইট' প্রযুক্তি সম্পর্কে, যা দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম।

দৃষ্টিশক্তি ফেরাবে নিউরালিংকের নতুন ব্রেন চিপ: অন্ধকারের পৃথিবীতে আসছে নতুন ভোর?

কল্পবিজ্ঞান নয়, সত্যি! ইলন মাস্কের নিউরালিংক নিয়ে আসছে যুগান্তকারী প্রযুক্তি। যে চোখে আলো ছিল না, সেখানে এখন ফুটবে রঙিন পৃথিবীর ছবি।

নিউরালিংক ব্লাইন্ডসাইট ব্রেন চিপের ধারণা চিত্রর
নিউরালিংকের ব্লাইন্ডসাইট ব্রেন চিপ মস্তিষ্কে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি করা হচ্ছে - কাল্পনিক চিত্র

একবার ভাবুন তো, জন্ম থেকে যে মানুষটি পৃথিবীর আলো দেখেনি, সে প্রথমবার তার মায়ের মুখ দেখছে। অথবা, দুর্ঘটনার কারণে দৃষ্টিশক্তি হারানো কোনো তরুণ ফিরে পাচ্ছে তার রঙিন স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা। যা এতদিন কেবল সিনেমার পর্দায় বা কল্পবিজ্ঞানের গল্পে সম্ভব ছিল, তাই এখন সত্যি হতে চলেছে ইলন মাস্কের হাত ধরে। তার মস্তিষ্ক-প্রযুক্তি কোম্পানি নিউরালিংক এমন এক চিপ তৈরি করেছে, যা সরাসরি মস্তিষ্কের সাথে সংযোগ স্থাপন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। এই অবিশ্বাস্য প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্লাইন্ডসাইট’ (Blindsight)

এই খবরটি শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতেই নয়, বরং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি দৃষ্টিহীন মানুষ এবং তাদের পরিবারের জন্য এক নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া জীবনগুলোতে আলো ফেরানোর এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ, উত্তেজনা এবং অপেক্ষা।

কী এই ব্লাইন্ডসাইট প্রযুক্তি? কীভাবে কাজ করবে এই চিপ?

সাধারণত, আমরা যখন কোনো কিছু দেখি, তখন আমাদের চোখের রেটিনা সেই আলোর তথ্যকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে পাঠায়। মস্তিষ্ক সেই সংকেত বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখার অনুভূতি দেয়। কিন্তু যদি চোখ বা অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয় এবং মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারায়।

নিউরালিংকের ‘ব্লাইন্ডসাইট’ প্রযুক্তি এই প্রথাগত প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এটি সরাসরি মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে কাজ করে।

এই প্রযুক্তিতে, ব্যবহারকারী একটি বিশেষ ক্যামেরা সম্বলিত চশমা পরবেন। এই ক্যামেরা পরিবেশের দৃশ্যপট ধারণ করে সেই ডেটাকে একটি ক্ষুদ্র প্রসেসিং ইউনিটে পাঠাবে। এই ইউনিটটি ভিডিও ডেটাকে মস্তিষ্কের বোঝার উপযোগী নিউরাল সিগন্যালে রূপান্তরিত করবে। এরপর, মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্থাপন করা নিউরালিংক চিপটি সেই সংকেত গ্রহণ করবে এবং কর্টেক্সকে উদ্দীপিত করবে। ফলে, চোখ বা অপটিক নার্ভকে ব্যবহার না করেই ব্যক্তিটি ‘দেখতে’ পাবে।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, নিউরালিংক একটি কৃত্রিম চোখ তৈরি করছে না, বরং এটি সরাসরি মস্তিষ্কের দৃষ্টি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রকে ‘বোঝাচ্ছে’ যে কী দেখতে হবে। এটি একটি বৈপ্লবিক ধারণা, যা অন্ধত্ব নিরাময়ের ধারণাকেই বদলে দিতে পারে।

ইলন মাস্কের ঘোষণা এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন

ইলন মাস্ক, যিনি তার স্বপ্ন এবং উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের জন্য পরিচিত, এই প্রযুক্তি নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে দৃষ্টি ফিরে আসবে, তার রেজোলিউশন খুব উন্নত হবে না। তিনি এটিকে অনেকটা "আদি নিন্টেন্ডো গেমের গ্রাফিক্সের" সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, প্রাথমিকভাবে হয়তো অস্পষ্ট কন্ট্যুর বা অবয়ব বোঝা যাবে।

কিন্তু মাস্কের স্বপ্ন এখানেই থেমে নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই চিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত দৃষ্টির মান কেবল সাধারণ মানুষের দৃষ্টির সমানই হবে না, বরং তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ হয়তো ইনফ্রারেড, আল্ট্রাভায়োলেট এমনকি র‍্যাডার তরঙ্গ পর্যন্ত দেখতে সক্ষম হবে! যা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে।

মানব পরীক্ষার দোরগোড়ায় নিউরালিংক

নিউরালিংক ইতোমধ্যে তাদের অন্য একটি প্রকল্প ‘টেলেপ্যাথি’ (Telepathy) নিয়ে সাফল্য পেয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম মানব রোগীর মস্তিষ্কে এই চিপ স্থাপন করা হয় এবং এরপর আরও বেশ কয়েকজন এই সুযোগ পেয়েছেন। তাদের সাফল্যের গল্পগুলো, যেমন শুধুমাত্র চিন্তা করে কম্পিউটার গেম খেলা বা বার্তা লেখা, ‘ব্লাইন্ডসাইট’ প্রকল্পের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) ‘ব্লাইন্ডসাইট’ প্রকল্পকে ‘ব্রেকথ্রু ডিভাইস’ বা যুগান্তকারী যন্ত্রের মর্যাদা দিয়েছে। এই তকমা পাওয়ায় প্রযুক্তিটির উন্নয়ন এবং পর্যালোচনার প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হবে।

আশা-আশঙ্কা এবং নৈতিকতার প্রশ্ন

নিউরালিংকের এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন বিশাল সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে, তেমনই কিছু আশঙ্কা এবং নৈতিক প্রশ্নও উঠে আসছে।

আশার আলো:

  • অন্ধত্ব নিরাময়: কোটি কোটি দৃষ্টিহীন মানুষের জীবনে আলো ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা।
  • নতুন দিগন্ত: জন্মগত অন্ধদের জন্য প্রথমবারের মতো পৃথিবী দেখার সুযোগ।
  • জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন: পক্ষাঘাতগ্রস্তদের মতো দৃষ্টিহীনরাও প্রযুক্তির সাহায্যে আরও স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।

আশঙ্কা ও বিতর্ক:

  • নিরাপত্তা: মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন একটি অত্যন্ত জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন।
  • খরচ: এই প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এই চিকিৎসা আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
  • ডেটা প্রাইভেসি: যেহেতু এই প্রযুক্তি সরাসরি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত, তাই ডেটা নিরাপত্তা এবং হ্যাকিং-এর ঝুঁকি একটি বড় উদ্বেগের কারণ।
  • অতিমানবীয় ক্ষমতা: এটি সমাজে এক নতুন ধরনের বৈষম্য তৈরি করতে পারে, যেখানে একদল মানুষ ‘সুপারহিউম্যান’ ক্ষমতা সম্পন্ন হবে।

শেষ কথা: এক নতুন বিপ্লবের সূচনা

সমস্ত বিতর্ক এবং আলোচনা সত্ত্বেও, নিউরালিংকের ‘ব্লাইন্ডসাইট’ এক অবিস্মরণীয় বিপ্লবের সূচনা করতে চলেছে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, এটি মানবতাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি। যে মানুষগুলো এতদিন কেবল শব্দ আর স্পর্শের মাধ্যমে পৃথিবীকে চিনেছে, তারা এখন রঙের উৎসবে সামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

হয়তো এখনও অনেকটা পথ বাকি। মানব পরীক্ষার ফলাফল, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা কাটানো এবং এটিকে সহজলভ্য করার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। অন্ধকারের বিরুদ্ধে মানুষের হাজার বছরের লড়াইয়ে নিউরালিংক এক নতুন এবং শক্তিশালী অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা, কবে এই প্রযুক্তি কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষের জীবনে সত্যি সত্যি নতুন ভোর নিয়ে আসবে।

🔔 আমাদের সাথে থাকুন — Bug Mohol এ বাংলায় সাইবার দুনিয়ার গভীরতম বিশ্লেষণ পাবেন।

🔗 Bug Mohol Telegram চ্যানেলে যোগ দিন

Post a Comment

Join the conversation

Join the conversation