Goo.gl: এক ক্লিকে বিশ্ব ছোট করা সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প | Bug Mohol

একসময়ের জনপ্রিয় Google URL Shortener 'goo.gl' কেন বন্ধ হলো? জানুন এর পেছনের কারণ ও সম্পূর্ণ ইতিহাস।
Goo.gl: এক ক্লিকে বিশ্ব ছোট করা সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প

Goo.gl: এক ক্লিকে বিশ্ব ছোট করা সেই বিশ্বস্ত সঙ্গীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প

Bug Mohol Cyber Desk | তারিখ: ২৮শে জুলাই ২০২৫

সাইবার নিরাপত্তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি প্রতীকী চিত্র
সাইবার জগৎ এবং প্রযুক্তির মেলবন্ধনের একটি প্রতীকী চিত্র।

আজকের ডিজিটাল পৃথিবীতে আমরা প্রতিদিন অগণিত লিঙ্কে ক্লিক করি। ফেসবুকের নিউজফিড, হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ কিংবা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইলে থাকা ছোট, ছিমছাম লিঙ্কগুলো আমাদের এক জগৎ থেকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। কিন্তু একবার ভাবুন তো, আজ থেকে দশ-বারো বছর আগের কথা? যখন ইন্টারনেট আজকের মতো এতটা গোছানো ছিল না, যখন টুইটারের অক্ষর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪০, তখন লম্বা এবং জটিল ওয়েব অ্যাড্রেসগুলো ছিল এক বিরাট বিড়ম্বনা। ঠিক সেই সময়ে আমাদের ডিজিটাল জীবনের এক বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে এসেছিল Google-এর একটি পরিষেবা—Goo.gl

এটি শুধু একটি লিঙ্ক ছোট করার টুল ছিল না; এটি ছিল আস্থা, সরলতা এবং প্রযুক্তির জাদুর এক দারুণ মিশ্রণ। কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই প্রিয় goo.gl আজ কোথায় হারিয়ে গেল? কেনই বা গুগল তার এত সফল একটি পরিষেবা বন্ধ করে দিল? এই প্রতিবেদনে আমরা শুধু একটি প্রযুক্তিগত পরিষেবার বিলুপ্তির গল্প বলব না, আমরা ফিরে দেখব ডিজিটাল যুগের এক অধ্যায়কে, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেকের স্মৃতি।

জন্ম এবং উত্থান: যখন সরলতাই ছিল সেরা সমাধান

সময়টা ২০০৯ সাল। ইন্টারনেট দুনিয়ায় তখন সোশ্যাল মিডিয়ার জয়জয়কার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে টুইটার তার ১৪০ অক্ষরের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক নতুন ধরনের যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি করেছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই—কোনো ওয়েবসাইটের লিঙ্ক শেয়ার করতে গেলেই তা প্রায় অর্ধেক অক্ষর খেয়ে নিত। লিঙ্কগুলো ছিল বিশাল, দেখতে অসুন্দর এবং মনে রাখা অসম্ভব। যেমন, একটি নির্দিষ্ট ইউটিউব ভিডিওর লিঙ্ক হতে পারত https://www.youtube.com/watch?v=dQw4w9WgXcQ এর মতো দীর্ঘ।

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে বাজারে আগে থেকেই TinyURL বা Bitly-এর মতো পরিষেবা ছিল। কিন্তু ব্যবহারকারীদের মনে সবসময় একটা দ্বিধা কাজ করত—এই থার্ড-পার্টি লিঙ্কগুলো কি নিরাপদ? আমার ব্যক্তিগত তথ্যের কোনো ঝুঁকি নেই তো?

ঠিক এই প্রেক্ষাপটে, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে গুগল তাদের নিজস্ব URL Shortener পরিষেবা হিসেবে goo.gl নিয়ে আসে। যেহেতু এটি ছিল স্বয়ং Google-এর পণ্য, তাই ব্যবহারকারীরা এটি গ্রহণ করতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। এর পেছনের মূল কারণ ছিল বিশ্বাস। মানুষ জানত, গুগল মানেই নিরাপত্তা এবং নির্ভরযোগ্যতা।

Goo.gl-এর ইন্টারফেস ছিল খুবই সাধারণ এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব। ওয়েবসাইটে গিয়ে লম্বা লিঙ্কটি পেস্ট করলেই সঙ্গে সঙ্গে goo.gl/ দিয়ে শুরু হওয়া একটি ছোট, সুন্দর লিঙ্ক তৈরি হয়ে যেত। এই সরলতাই ছিল এর সবচেয়ে বড় শক্তি। সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে বড় বড় ডিজিটাল মার্কেটার, সকলেই এর সুবিধা বুঝতে পারছিল।

স্বর্ণযুগ: শুধু লিঙ্ক ছোট করা নয়, আরও অনেক কিছু

Goo.gl কেবল লিঙ্ক ছোট করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। গুগল এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল শক্তিশালী অ্যানালিটিক্স টুলস, যা এটিকে অন্য প্রতিযোগীদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়। একজন ব্যবহারকারী তার তৈরি করা প্রতিটি শর্ট লিঙ্কের কার্যকারিতা ট্র্যাক করতে পারতেন।

বিষয়টা ছিল রীতিমতো বিপ্লবী। ধরুন, আপনি একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা ব্যবসায়ী। আপনি আপনার নতুন পণ্যের লিঙ্ক ফেসবুক, টুইটার এবং ইমেইলে শেয়ার করলেন। Goo.gl ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে আপনি দেখতে পেতেন:

  • মোট কতবার আপনার লিঙ্কে ক্লিক করা হয়েছে।
  • কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ক্লিক এসেছে।
  • ব্যবহারকারীরা কোন ব্রাউজার (ক্রোম, ফায়ারফক্স) বা অপারেটিং সিস্টেম (উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড) ব্যবহার করছে।
  • সময়ের সঙ্গে ক্লিকের প্রবণতা কেমন (দিনের কোন সময়ে ক্লিক বেশি হচ্ছে)।

এই তথ্যগুলো মার্কেটারদের জন্য সোনার খনির মতো ছিল। তারা তাদের প্রচারণার কার্যকারিতা নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে পারতেন এবং সেই অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে পারতেন। এর ফলে goo.gl ডিজিটাল মার্কেটিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ছোট ব্যবসা, ব্লগার, সাংবাদিক, সকলেই তাদের কন্টেন্টের প্রসার মাপার জন্য এই বিনামূল্যের টুলটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

পাশাপাশি, QR কোডের সঙ্গে এর সমন্বয় ছিল দুর্দান্ত। প্রিন্ট মিডিয়া, পোস্টার বা বিজনেস কার্ডে লম্বা লিঙ্ক দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু goo.gl দিয়ে তৈরি ছোট লিঙ্ক ব্যবহার করে সহজেই QR কোড জেনারেট করা যেত, যা স্মার্টফোন দিয়ে স্ক্যান করে মানুষ সরাসরি ওয়েবসাইটে পৌঁছে যেত। এভাবেই ডিজিটাল এবং ভৌত জগতের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল এই পরিষেবা।

বদলের হাওয়া এবং অবসরের ঘোষণা: কেন থামতে হলো বিশ্বস্ত সঙ্গীকে?

সব ভালো গল্পেরই হয়তো একটি শেষ থাকে। প্রযুক্তির জগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে হারিয়ে যাওয়াই নিয়ম। Goo.gl-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

২০১৮ সালের ৩০শে মার্চ গুগল একটি ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে ঘোষণা করে যে তারা তাদের ৮ বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই জনপ্রিয় পরিষেবাটি বন্ধ করে দিতে চলেছে। এই ঘোষণা অনেক ব্যবহারকারীর কাছেই ছিল একটি বড় ধাক্কা। প্রশ্ন উঠল, কেন গুগল তাদের এত সফল এবং বিশ্বস্ত একটি পণ্যকে অবসরে পাঠাচ্ছে?

এর পেছনে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ ছিল।

  1. ইন্টারনেটের পরিবর্তন: যে মূল সমস্যা সমাধানের জন্য goo.gl তৈরি হয়েছিল, সেই সমস্যাটির তীব্রতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ততদিনে তাদের নিজস্ব লিঙ্ক শর্টনার (t.co) তৈরি করে ফেলেছিল, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব লিঙ্ককে ছোট করে দিত। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীদের আলাদা করে লিঙ্ক ছোট করার প্রয়োজন কমে আসছিল।
  2. মোবাইল ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড এবং অ্যাপের উত্থান: ইন্টারনেট ডেস্কটপ থেকে মোবাইল ফোনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। ব্যবহারকারীরা ওয়েবসাইটের চেয়ে অ্যাপ ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। এখন চ্যালেঞ্জটা শুধু ওয়েবসাইটে ট্র্যাফিক পাঠানো ছিল না, বরং ব্যবহারকারীকে একটি লিঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি অ্যাপের নির্দিষ্ট কোনো পেজে (Deep Linking) নিয়ে যাওয়া ছিল বেশি জরুরি। যেমন, একটি ইকমার্স সাইটের পণ্যের লিঙ্কে ক্লিক করলে যেন সরাসরি সেই পণ্যটি তাদের অ্যাপে ওপেন হয়। Goo.gl এই কাজটি করার জন্য তৈরি হয়নি।
  3. গুগলের নতুন কৌশল এবং Firebase Dynamic Links (FDL): গুগল ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল। তাদের নতুন লক্ষ্য ছিল ডেভেলপারদের জন্য আরও শক্তিশালী এবং স্মার্ট টুল তৈরি করা। এই লক্ষ্যের অংশ হিসেবে তারা নিয়ে আসে Firebase Dynamic Links (FDL)। FDL ছিল goo.gl-এর একবিংশ শতাব্দীর সংস্করণ। এটি একটি স্মার্ট লিঙ্ক, যা ব্যবহারকারীর ডিভাইসের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। যদি ব্যবহারকারীর ফোনে নির্দিষ্ট অ্যাপটি ইনস্টল করা থাকে, তবে লিঙ্কটি অ্যাপের ভেতরে খুলবে। আর যদি অ্যাপ ইনস্টল করা না থাকে, তবে তাকে প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরে নিয়ে যাবে অথবা ওয়েবসাইটে খুলবে। এই জটিল কাজটি goo.gl-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

তাই গুগল তাদের পুরনো কিন্তু সীমিত ক্ষমতার টুলটি বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত মনোযোগ এবং রিসোর্স নতুন এবং ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের টুল FDL-এর দিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

শেষের সে দিন এবং রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার

গুগল হুট করে পরিষেবাটি বন্ধ করেনি। তারা ব্যবহারকারীদের সময় দিয়েছিল। ২০১৮ সালের ১৩ই এপ্রিলের পর থেকে নতুন ব্যবহারকারীরা আর goo.gl-এ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছিল না। পুরনো ব্যবহারকারীদের ২০১৯ সালের ৩০শে মার্চ পর্যন্ত লিঙ্ক তৈরি এবং অ্যানালিটিক্স দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় ছিল, গুগল জানিয়েছিল যে পূর্বে তৈরি করা সমস্ত goo.gl লিঙ্ক চিরকাল কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ, পুরনো কন্টেন্টে থাকা লিঙ্কগুলো আজও কাজ করে, যা গুগলের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়।

Goo.gl আজ আর নেই, কিন্তু এটি ডিজিটাল দুনিয়ায় তার ছাপ রেখে গেছে। এর উত্তরাধিকার কেবল একটি বিলুপ্ত পরিষেবা নয়, বরং একটি দর্শন।

  • আস্থার প্রতীক: এটি প্রমাণ করেছিল যে একটি বড় প্রযুক্তি সংস্থা যখন ব্যবহারকারীদের জন্য সরল, নির্ভরযোগ্য এবং বিনামূল্যের টুল সরবরাহ করে, তখন সেটি কতটা জনপ্রিয় হতে পারে।
  • তথ্যের শক্তি: এটি সাধারণ মানুষের হাতে ডেটা অ্যানালিটিক্সের শক্তি তুলে দিয়েছিল। কন্টেন্ট শেয়ারিংকে অনুমানের খেলা থেকে বের করে এনে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে পরিণত করেছিল।
  • প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের স্মারক: Goo.gl-এর উত্থান ও পতন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তি জগতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আজকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় টুলটিও আগামীকালের প্রেক্ষাপটে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেতে পারে। এটি আমাদের শেখায় যে পরিবর্তনকে গ্রহণ করা এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।

উপসংহার: স্মৃতির পাতায় এক ডিজিটাল সঙ্গী

Goo.gl ছিল সেই বন্ধুর মতো, যে কঠিন সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। যখন লম্বা লিঙ্কগুলো ছিল এক বিভীষিকা, তখন সে এক ক্লিকে সেগুলোকে সহজ করে দিয়েছিল। যখন আমাদের জানতে ইচ্ছে করত আমাদের লেখা বা সৃষ্টি কতজন মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, তখন সে নীরবে সেই হিসেব আমাদের সামনে তুলে ধরত।

আজ যখন আমরা Firebase Dynamic Links বা অন্যান্য আধুনিক লিঙ্কিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করি, তখন হয়তো আমাদের মনে থাকে না যে এই যাত্রার শুরুটা হয়েছিল goo.gl-এর মতো সরল একটি টুল দিয়ে। এটি ছিল সেই সেতু, যা আমাদের ইন্টারনেটের এক যুগ থেকে অন্য যুগে নিয়ে এসেছে। তাই goo.gl শুধু একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ওয়েব ঠিকানা নয়, এটি ইন্টারনেট ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমাদের ডিজিটাল জীবনের এক মিষ্টি স্মৃতি, যা আমাদের শেখায়—প্রযুক্তি বদলাবে, কিন্তু তার রেখে যাওয়া প্রভাব রয়ে যাবে চিরকাল।

🔔 আমাদের সাথে থাকুন — Bug Mohol এ বাংলায় সাইবার দুনিয়ার গভীরতম বিশ্লেষণ পাবেন।

🔗 Bug Mohol Telegram চ্যানেলে যোগ দিন

إرسال تعليق

الانضمام إلى المحادثة

الانضمام إلى المحادثة